সুন্দর সেন্ট মার্টিনের ভাঙ্গা জেটি ফাঁড়ি

Jan 6, 2025 - 10:45
 0  0
সুন্দর সেন্ট মার্টিনের ভাঙ্গা জেটি ফাঁড়ি

সেন্ট মার্টিন বঙ্গোপসাগরের একটি 8 বর্গকিলোমিটার প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ। পর্যটক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বীপে আসা-যাওয়ার একমাত্র ভরসা হল পূর্ব তীরে অবস্থিত জেটি। 2002 সালে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রায় 40 মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে 350 মিটার দীর্ঘ একটি জেটি নির্মাণ করে। জেটির প্রস্থ ১৮ ফুট। জেটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় কক্সবাজার জেলা পরিষদ।

কিন্তু ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে জেটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর টানা ১১ বছর জেটি সংস্কার করা হয়নি। জেলা পরিষদ কয়েক বছর ধরে সংস্কার করলেও জেটিটি এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

গত ৮ ও ৯ ডিসেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, জেটির দুই পাশের রেলিং ভেঙে পড়েছে। ইট ও সিমেন্ট খসে পড়ে। জেটির মাঝখানের ঢালাইয়ের (ফ্লোর) কিছু অংশ ধসে পড়েছে। পর্যটকদের চলাচলের সুবিধার্থে সেখানে কাঠের তক্তা বসানো হয়েছিল। জেটির মাঝখানে দুই পাশে নৌকায় ওঠা ও নামার জন্য নির্মিত দুটি সিঁড়িও ভেঙে পড়েছে। সেখানেও তক্তা বিছিয়ে লোকজনকে নৌকায় ওঠানো হচ্ছে। জেটির শেষ প্রান্তে (বাজারের কাছে) কমপক্ষে 160 ফুট বালি তলিয়ে গেছে। একযোগে কয়েক হাজার পর্যটক জেটিতে উঠলে জরাজীর্ণ জেটি দুলতে থাকে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা জানান, জরাজীর্ণ জেটিটি যে কোনো সময় সাগরে ভেঙ্গে বা ধসে পড়তে পারে। প্রাণ হারাতে পারে পর্যটকসহ বহু মানুষ। জেটি সংস্কারে জেলা পরিষদ প্রায় সাত কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজ শুরু হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, জেটি নির্মাণের পর থেকে নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের কোনো জাহাজ জেটিতে ডকেনি। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে 7-10টি পর্যটন জাহাজ জেটিতে ছুটে আসছে। জাহাজের ধাক্কায় জেটির ভিত্তি ও কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গত ১ ডিসেম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে কক্সবাজার শহর থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু করে। বর্তমানে পাঁচটি জাহাজে করে দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করছেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাহাজগুলো সেন্ট মার্টিন জেটিতে ধাক্কা মারে। বিকাল ৩টার দিকে জাহাজটি পর্যটকদের নিয়ে কক্সবাজার শহরে ফিরে আসে। জাহাজগুলো কক্সবাজার-সেন্ট রুটে চলাচল করবে। মার্টিন সমুদ্র পথে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

৮ই ডিসেম্বর আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গিয়ে দেখি জেটির সামনের পন্টুনে জাহাজটি ধাক্কা লেগে জেটি কাঁপছে। এরপর জাহাজের আট শতাধিক যাত্রী (পর্যটক) তাড়াহুড়ো করে ভাঙা জেটি থেকে নামতে শুরু করেন। একই সময়ে আরেকটি জাহাজ জেটিতে ধাক্কা মারে। সেই জাহাজ থেকে আট শতাধিক পর্যটকও নেমেছিলেন।

দেখা গেল হাজার হাজার পর্যটক জেটি থেকে নেমে দ্বীপের দিকে হাঁটা শুরু করেছে। জেটিতে পর্যটকদের পণ্যবাহী যানবাহন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পর্যটকদের পায়ে হেঁটে পুরো জেটি পার হতে হয়। হাঁটার সময় অনেকে জেটির মেঝেতে বিছানো কাঠের তক্তা বা ভাঙা তক্তায় আটকে যায়। সহস্রাধিক পর্যটক একযোগে নামার জন্য ছুটে আসায় কেউ কেউ ভাঙা রেলিং ভেদ করে প্রায় সমুদ্রে পড়ে যান।

ঢাকার রামপুরা এলাকার ব্যবসায়ী মনোয়ার আলম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সেন্টমার্টিন বেড়াতে গিয়েছিলেন। ভিড় এড়িয়ে জাহাজ থেকে জেটির পন্টুনে নামতে তাদের আধা ঘণ্টা লেগেছিল। এরপর জেটিতে তারা বিপাকে পড়েন। স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তানকে কোলে তুলে নেন। দুজন দুজনের হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে থাকল। কিছুদূর যাওয়ার পর ভাঙা কাঠের তক্তার ওপর আটকে পড়ে স্ত্রী। মনোয়ার আলম সযত্নে দুই সন্তান ও পরে স্ত্রীকে ভাঙা অংশ পার করে নিয়ে যান। জেটির শেষ প্রান্তে বাজারে পৌঁছে সে পালিয়ে যায়। ক্ষুব্ধ মনোয়ার আলম বলেন, দ্বীপের একমাত্র জেটির নাজুক অবস্থা পর্যটকদের হতাশ করছে। দ্বীপের মাটিতে ভাঙ্গা রেলিং এবং ফুটো তক্তাগুলো অতিক্রম করা নারী ও শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

জাহাজ মালিকদের সংগঠন সী ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসেন ইসলাম বাহাদুর জানান, দুই বছর আগে জেটির পন্টুন ও ফুটো অংশে কাঠের তক্তা বসাতে ব্যয় হয়েছিল ১৬ কোটি টাকা। রোদ-বৃষ্টিতে কাঠের তক্তা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন জেটি নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। পর্যটকদের জাহাজ থেকে সাবধানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নতুন জেটি নির্মাণ হলে ঝুঁকি কমবে।

সেন্ট মার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর দীর্ঘ ১১ বছর জেটি সংস্কার করা হয়নি। সে সময় প্রতিদিন ৬ থেকে ১৫ হাজার পর্যটক দ্বীপে যাওয়া-আসা করতেন। এরপর দুই দফায় সংস্কার কাজ করা হলেও বর্তমানে জেটিটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জেলা পরিষদ গত জুনে জেটি সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল মারুফ বলেন, জেটি সংস্কারের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, একজন ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে সংস্কার কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও উত্তাল সমুদ্রের কারণে তা সম্ভব হয়নি। নভেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সেন্ট মার্টিন। এ কারণে জেটির সংস্কার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ৩১ জানুয়ারির পর থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক চলাচল বন্ধ থাকবে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে জেটির কাজ শুরু হবে। জেটির বেশির ভাগ অংশই বালিতে তলিয়ে গেছে। নতুন জেটির উচ্চতা বাড়ানো হবে, রেলিংসহ বিভিন্ন কাজে লোহার পরিবর্তে স্টিলের অবকাঠামো বসানো হবে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow