১৪ দলীয় জোটের শরিকদের অফিস খুললেও মাঠে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা
আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও গভীর সংকটে রয়েছে। এই দলগুলোর এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আবার কবে নাগাদ রাজনীতির মাঠে নামতে পারবেন এমন প্রশ্নে দলগুলোর নেতাকর্মীরা হতাশা বাড়ছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর তারা জনসম্মুখে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারেননি। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তারের পর শরিক দলগুলোর অন্য নেতারাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন।
তবে ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), কমিউনিস্ট কেন্দ্রসহ ১৪ দলের প্রায় সব শরিক দলের কার্যালয় খোলা রয়েছে এবং নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নগণ্য। শীর্ষ নেতাদের আনাগোনা নেই। মধ্যম সারির ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী অফিসে আসেন।
১৪ দলের শরিকদের সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সব কিছুর প্রতি সমর্থন দেওয়ায় ১৪ দলের শরিকরা তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান পুরোপুরি হারিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও কৌশল মেনে চলছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হওয়া বা ক্ষমতার ভাগ পাওয়া। এখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব, সরকারসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের শরিকদের একই 'বন্ধনীতে' রেখেছে। ফলে ১৪ দলের শরিকদের ভাগ্যও আওয়ামী লীগের ভাগ্যের সঙ্গে মিশে গেছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরলে শরিকদের কিছুটা সুযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর শরিক দলগুলোর দুই-তিন নেতা দেশ ছেড়েছেন। কেউ কেউ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। মামলায় নাম থাকা অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ সূত্রে জানা গেছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। দলীয় সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট থেকে দলের কার্যালয়ে আসেননি সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও কারাগারে রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট থেকে দলীয় কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না দলের মহাসচিব শিরীন আখতারকে। এদিকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। তবে অফিসটি এখন হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের নিয়ন্ত্রণে।
জানা গেছে, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও দলের মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম দলীয় কার্যালয়ে যাননি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ডেমোক্রেটিক পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। কোনো দলই এখন সেভাবে সক্রিয় নয়। মধ্যম সারির এক নেতা দলীয় কার্যালয় পরিদর্শনে গেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও দলের কার্যক্রম সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, তাদের নিজস্ব রাজনীতি আছে। তা চালানোর চেষ্টা চলছে। তবে প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিকূল পরিবেশের অবসান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ওই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঐক্য হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। শুরুতে তরিকত ফেডারেশন ও জাপা জোটে ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তারা যোগ দেয়।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও জোটের অন্য শরিক দলগুলো হলো- বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), জেপি, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল। (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এটিকে ১৪ দলীয় জোট বলা হলেও এখন জোটে ১২টি দল রয়েছে।
৫ আগস্টের পর মেনন ও ইনু ছাড়াও দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শিরিন আক্তারসহ অনেক নেতাকে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে।
শীর্ষ নেতাদের জন্য শেষের শুরু
১৪ দলের অধিকাংশ শরিক দল দু-একজন শীর্ষ নেতাকে কেন্দ্র করে। শরিক দলের মধ্যম সারির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৪ দলের শরিকদের বিপর্যয় শুরু হয়। এরপর আওয়ামী লীগ কম আসনে ছাড় দেয় এবং অধিকাংশ শরিক নেতা ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে যান। ১৫ আগস্টের হৃদয় পরিবর্তনের পর মামলা-গ্রেফতারে বিপর্যস্ত শীর্ষ নেতারা। এ অবস্থায় অনেকেই হয়তো তাদের নির্বাচনী রাজনীতি শেষ করার পথে।
গত নির্বাচনে জোটের মনোনয়ন পেয়েও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান জেএসডি সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ঢাকা-৮ আসন থেকে তিনবারের সংসদ সদস্য হলেও গতবার তাকে ওই আসন থেকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। এ সময় তার দলের একাধিক নেতা তাকে ভোট না দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক তদবিরের পর বরিশাল থেকে ভোটে জয়ী হন তিনি। ৮২ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের জন্য নির্বাচনী রাজনীতিতে ফেরা কঠিন হবে বলে মনে করছেন দলের অন্য নেতারা।
১৪ দলের শরিকদের সূত্র জানায়, শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। গত নির্বাচনে তিনি জোটের মনোনয়ন না পেয়ে নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে দাঁড়ান এবং পরে প্রত্যাহার করে নেন। দিলীপ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, গত নির্বাচনের আগে তাকে শেষবারের মতো জোটের প্রার্থী করতে ব্যর্থ হন এই নেতা। তার জন্য আবার ফিরে আসা কঠিন।
জাপা সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাতবারের সংসদ সদস্য ও একাধিকবার মন্ত্রী ছিলেন। গত নির্বাচনে তার এক সময়ের ব্যক্তিগত সহকারী ও স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ তাকে পরাজিত করার পর তার নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির অবসান দেখছেন জোটের অনেকেই। মঞ্জুর বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর মঞ্জুকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগে শরিকরা উধাও
আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ১৪ দলের একাধিক শরিক নেতা। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার সময় কৌশলগতভাবে ১৪ দলের শরিকদের ব্যবহার করেছিলেন।
What's Your Reaction?