প্রাক্তন এয়ারফোর্স অফিসার লাভের জন্য 'প্লাম গার্ডেন' শুরু করেন, শুরু করেন সামাজিক দায়বদ্ধতা
সে সময় করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে। করার মতো কোনো কাজ ছিল না। হাতে অনেক সময়। সময় নষ্ট না করে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে অনেক চিন্তা ছিল। অন্যদিকে, সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে দায়িত্ব নেওয়া কিছু সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ সংকট কাটিয়ে ওঠার চিন্তাও রয়েছে। উপায় খুঁজতে গিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আবুল ফজল একটি ভিডিওতে বরই (কুল) বাগান দেখে নিজের 'বরই বাগান' শুরু করতে অনুপ্রাণিত হন।
ইচ্ছার সাথে কিছু সুযোগ আসে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের বাউরবাগ গ্রামে গড়ে উঠেছে চারটি ‘বরই বাগান’। এটিকে একটি ব্র্যান্ড নামও দেওয়া হয়েছে 'তালুকদার এগ্রো'। সবুজ, লাল ও সোনার মিশ্রণে বরই এখন বাগানের গাছে ঝুলছে। বাড়ির পাশে, ধান ক্ষেতের পাশে এসব বাগান গ্রামে ভিন্ন সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।
গত বুধবার সকালে মৌলভীবাজারে কুয়াশা নেমে আসে। জলের ফোঁটার মতো কুয়াশা পড়ছিল। জেলা সদর থেকে বাউরভাগ গ্রাম 20-22 কিলোমিটার দূরে। কুয়াশা ভেদ করে আমরা যখন গ্রামে পৌঁছলাম, তখনও গ্রামটি ঘুমিয়ে আছে। শীতকালে খুব ঠান্ডা পড়ে। কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। সবেমাত্র আমন ধান কাটা হয়েছে। ঘরে ঘরে ধান কাটা শেষ, অবসর চলছে। মৌলভীবাজার-শেরপুর আঞ্চলিক সড়ক থেকে গ্রামের একটু ভেতরে বরই বাগানে গেলে দেখা যায় কুয়াশায় ডুবে থাকা গাছগুলো। পরিবেশ শান্ত এবং শান্ত। তবে কিছুটা উত্তেজনাও রয়েছে। অনেক ঘুঘু অবিরাম ডাকছে গ্রামকে জাগানোর জন্য। গোল সবুজ পাতার ফাঁকে ডালে ছোট-বড় অনেক বরই ঝুলে আছে। কেউ সবুজ, কেউ লাল, কেউ সোনালি রঙ ধারণ করেছে। বাদুড় ও অন্যান্য পাখির উপদ্রব এড়াতে গাছে সারি সারি নকল পাতা।
এই কৃষি উদ্যোক্তা হলেন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃ আবুল ফজল। তিনি জানান, শৈশব থেকেই তিনি কৃষিকাজে আগ্রহী। সুযোগ পেলেই ছুটে যান ফসলে। কাজ করার সময় সময় বের করা বেশ কঠিন ছিল। তবে কৃষির চিন্তা কখনোই তার মন থেকে যায় নি। করোনার সময় খুব একটা কাজ ছিল না। তিনি ভাবছিলেন সময় নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। অন্যদিকে তিনি (আবুল ফজল) ও তার স্ত্রী শিক্ষিকা তালুকদার আমেনা ফজল কিছু সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান এই সময়ে, শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে এই অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খরচ মেটাতে তিনি প্রথমে কিছু টাকা ব্যাংকে রাখার কথা ভেবেছিলেন। এর থেকে যে লাভ হবে তা তাদের শিক্ষিত করতে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু কৃষি ও গণমাধ্যমকর্মী শাইখ সিরাজের একটি ভিডিও দেখার পর তিনি 'বরই বাগান' শুরু করতে আগ্রহী হন।
2019 সালে, আবুল ফজল সদর উপজেলার বাউরবাগ এলাকায় সাড়ে তিন কিয়ার (1930 সালে 1 কিয়ার) জমিতে বরই চাষ শুরু করেন। এই উদ্যোক্তা প্রতি বছর কিয়ার প্রতি 10,000 টাকায় জমি লিজ নেন। ছাত্রদের জন্য যে টাকা ব্যাংকে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন তার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করলেন। বাগানটি বড় করতে প্রথম বছরে তার খরচ হয়েছে প্রায় ছয় লাখ টাকা। পরে ধীরে ধীরে প্রায় ১০ কিয়ার জমিতে চারটি বরই বাগান গড়ে তোলেন। এ পর্যন্ত তার খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টাকা। তবে এই বিনিয়োগের টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এখন বাগানের আয় দিয়ে বাগানের খরচ মেটানো হচ্ছে। চারজন নিয়মিত কর্মী রয়েছেন। তার তত্ত্বাবধানে শ্রমিকরা বাগান দেখাশোনা করে। তাদের (শ্রমিকদের) মাসিক বেতন ৪০ হাজার টাকা।
আবুল ফজল বলেন, "আমি তাদের (শিক্ষার্থীদের) লেখাপড়া করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন খরচ মেটাতে আমার খুব খারাপ অবস্থা ছিল। এই শিক্ষার্থীরা পাঁচ-সাত বছর ধরে আমাদের সঙ্গে আছে। কারও বিয়ে হয়েছে, কারও বিয়ে হয়েছে। অসুস্থ হলে তাদের নিয়ে এসে চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করছি, এখন বাগানের আয় থেকে তাদের জন্য জমিতে রাখব। '
এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন অনার্সে, একজন ডিগ্রি ফাইনালে এবং একজন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীও মাঝেমধ্যে বাগানে এসে কাজ করে। তবে এ আয় থেকে তিনি অন্য খাতে ব্যয় করেন। সুনামগঞ্জে তার গ্রামের বাড়ি এলাকায় ফুটবল খেলা হয়। তিনি তার বাগানের আয় থেকে খেলোয়াড়দের জার্সি, পুরস্কার এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচ প্রদান করেন। সব খরচ বাদ দিয়েও বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুনাফা রয়েছে তার।
আবুল ফজল জানান, অক্টোবর থেকে বাগানের গাছে মুকুল আসতে শুরু করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফল বাছাই শুরু হয়। আড়াই থেকে তিন মাস ফল থাকে। তিনি তার বাগানে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। এবার তিনি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে বরই বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কেজি বরই বিক্রি হয়েছে। এগুলো বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে। ফলের বেশিরভাগই বাগান থেকে বিক্রি হয়। অনেকে অনলাইনেও অর্ডার দেন।
আবুল ফজল শুধু বরই বাগান করেই ক্ষান্ত হননি; হবিগঞ্জ, সিলেটের সারিঘাট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে চার-পাঁচটি বাগান করেছেন। তার বরই বাগানে রয়েছে নূরানী কাশ্মীরি আপেল কুল, অস্ট্রেলিয়ান বল সুন্দরী, ভারত সুন্দরী, চায়না সোর-মিষ্টি, কোকোনাট কুল, জাম্বু কুল এবং ঢাকা-৯০ জাতের বরই। তারা সব একই সময়ে পাকে না। প্রতিটি জাত পর্যায়ক্রমে পাকে। তার বাগানে এখন প্রায় তিন হাজার গাছ রয়েছে। এই বরইকে কেন্দ্র করে তার কিছু ইচ্ছা ও আকাঙ্খাও রয়েছে। এই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি সময়ের আগেই স্বেচ্ছায় বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসর নেওয়ার এক বছর হয়ে গেল।
আবুল ফজল বলেন, "আমি এখন একজন পূর্ণাঙ্গ কৃষক। আমি একজন উদ্যোক্তা হয়েছি। আমি একটি আন্দোলন শুরু করছি। আমি সিলেট অঞ্চলের বেকার ছেলেমেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে চাই। তারা বিভিন্ন দেশে গিয়ে এত টাকা আয় করতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্য এবং এর চেয়েও কঠোর পরিশ্রম করে আমি আমার নিজের খরচে তরুণদের কাজে লাগাতে চাই আমি তাদের বোঝাতে চাই যে মাটি বিশ্বাসঘাতকতা করে না।"
What's Your Reaction?